
মা-বাবার ঠিকানা যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয় শক্ত হাতে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ৭৫ বছর বয়সি রহিমা বেগম। অশ্রুতে দুই চোখ ছলছল। হয়তো ফেলে আসা দিনগুলোতে ফিরে গিয়ে তিনি জীবনের হিসাব কষছেন। ঠিক কোন জায়গায় তার ভুল ছিল? যে ভুলের শাস্তিস্বরূপ ছেলে, বউমা, মেয়ে, জামাই, নাতি নাতনিতে ভরা সংসার থাকা সত্ত্বেও তার ঠাঁই এই বৃদ্ধাশ্রমে?
এমনও হাজার মা-বাবার বৃদ্ধ বয়সে ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। বার্ধক্য হলো জীবনের শেষ পর্যায়। অনিবার্য পরিণতি। জীবনের প্রথম ও শেষ বয়সে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। দুই বয়সেই মানুষ শিশু হয়ে যায়, পরনির্ভরশীল হয়ে যায়। সমাজ ও পরিবারের কাছে প্রবীণেরা চায় সম্মান ও ভালোবাসা। জীবনের শেষ বেলায় সন্তানের সান্নিধ্য ও পরিজনের সঙ্গ খুব প্রয়োজন।
কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতির নির্মম ও কলঙ্কময় উপহার হিসেবে প্রবীণ নিবাস ও বৃদ্ধাশ্রম ছেয়ে গেছে সমাজের সব স্তরে, যা মানবতার নির্মম বন্দিশালা। বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিটি প্রবীণ ব্যক্তি শুধু পথ চেয়ে বসে থাকে তার আপনজনের আশায়। দীর্ঘ অপেক্ষার যেন শেষ নেই। সারাটি জীবন যে সংসার, সন্তান-সন্ততির কথা চিন্তা করে, তাদের মঙ্গলের জন্য মা-বাবা দিনরাত পরিশ্রম করেছেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে নিজেদের শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে হলেও সন্তানকে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, আজ সেই সংসার থেকে তাদের দূর করে দেওয়া হয়েছে। সামান্য ঠাঁই, সহানুভূতি, ভালোবাসা তারা পান না।
বর্তমানে কাজের তাগিদে বা আরো অনেক কারণে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে বিভক্ত হয়েছে ছোট পরিবারে। স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সন্তান নিয়ে গঠিত সেই পরিবার। আধুনিক সভ্যতার সব উপকরণ, ব্যক্তি বিলাসের সব উত্স দিয়ে সাজানো সেই সংসার, শুধু নেই প্রবীণ মা-বাবার কোনো ঠাঁই।
এভাবেই আজ দেশময় বহু প্রবীণকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। সন্তানের কাছে ঠাঁই হয়নি বাবা-মায়ের, রাস্তায় ফেলে গেছে অসুস্থ বাবা-মাকে, চিকিত্সার অভাবে অনেকে মারা গেছে এমন অনেক নিষ্ঠুর সংবাদ প্রতিদিন আমাদের নজরে আসে। কিন্তু টনক করে কতজনের?
বাবা-মা কর্মক্ষম হয়ে গেলে তাদের বোঝা ভাবতে শুরু করে সন্তান-সন্ততি। অথচ সেই বয়সে বাবা-মায়ের পাশে তাদের সন্তানদের লাঠি হিসেবে থাকার কথা, ঠিক যেভাবে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে বাবা-মা তাকে আগলে রেখেছেন। বাবা-মা কখনো বোঝা নয়, তারা অভিজ্ঞ বটবৃক্ষের মতো। তারা জীবনকে আরো অনেক কাছ থেকে চেনেন। তাদের পরামর্শ আমাদের জীবনে সামনে এগোতে অনেক সহায়ক।
বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে, তা প্রত্যেক মানুষের ভাবা উচিত। অনেক সময় নিজের কর্মসংস্থান ও ভালো কাজের সুযোগের জন্য দূরে থাকতে হয়, সেই মুহূর্তেও যেন বাবা-মায়ের সামান্য কষ্ট না হয়, তার সমস্ত বন্দোবস্ত করা প্রতিটি সন্তানের দায়িত্ব। আর আপনি নিজের বাবা-মায়ের সঙ্গে ঠিক যেভাবে আচরণ করবেন, আপনার চোখের মণি আপনার সন্তানও আপনার কাছ থেকে সেরকম ব্যবহার করতে শিখবে। তাই নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হলেও আজকেই নিজেকে পরিবর্তন করুন। বাবা-মা বোঝা নন, সবচেয়ে আপনজন, সন্তানের নির্ভরতার স্থান। তাই কোনো মা-বাবার ঠিকানা যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়, তাদের ঠিকানা যেন সন্তানের ভরা সংসারেই হয়। ভালো থাকুন পৃথিবীর সব বাবা-মা।
লেখক ; শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়