
হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলা একটি সমৃদ্ধ ভাষা। পৃথিবী রবে যতদিন, বাংলা ভাষাও রবে ততদিন। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সব ভাষা শহীদদের, সেইসব ভাষা-সংগ্রামীদের যাদের বুকের তাজা রক্তে ৫২’তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার পিচঢালা রাজপথ। “রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই” এ আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য আন্দোলন ছিলো না, ছিলো প্রতিটি বাঙালির অস্তিত্বের আন্দোলন। ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির কাছে আত্মত্যাগ, শ্রদ্ধা ও অহংকারের মাস। বাঙালী জাতির কাছে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রেরণার মাস ফেব্রুয়ারি। মহান এ ভাষার মাসে বাংলা ভাষাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থীর ভাবনা, মতামত ও প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।
অনন্য প্রতীক রাউত- শিক্ষার্থী, আইন বিভাগজগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়– (স্বগৌরবে টিকে থাকুক বাংলা ভাষা) – বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পিছনে যেহেতু রাজপথের রক্ত-রঞ্জিত ইতিহাস রয়েছে তাই বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ খুবই হৃদয়বিদারক। বর্তমান প্রজন্ম জেনে বা না জেনে প্রতিনিয়ত যা করে চলেছে। পাশাপাশি, ভিনদেশী সংস্কৃতির চর্চার কারণে ধ্বংস হচ্ছে নিজস্ব ভাষাগত ঐতিহ্য। আন্তজার্তিক মাতৃভাষা হিসাবে ইংরেজিকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে বাংলা ভাষাকে সুকৌশলে অবহেলা করা হচ্ছে তা থেকে বেরি আসাও অতীব জরুরি। ভাষার মাসে বইমেলার আয়োজন করে, বাঙ্গালীয়ানা পোশাক পড়েই আমরা কেবল স্বরণ করি বাংলা ভাষার ইতিহাস। শুদ্ধতার সহিত ভাষা ব্যবহারের চমক দেখাই। অথচ ৩৬৫ দিনই হওয়া উচিত এমন। বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের ধমনিতে বহমান রক্তের মতো চিরন্তন সত্য। মায়ের কাছ শেখা ভাষা মায়ের মতোই পবিত্র। তাই, বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ বা বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক অবহেলার যে বেড়াজাল সৃষ্টি হয়েছে তা ভেঙ্গে প্রাণের বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। টিকে থাকুক বাংলাভাষা স্বগৌরবে, বিজয়ের নিশান উড়িয়ে এটাই কামনা।
নিগার সুলতানা সুপ্তি- শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়- (বাংলা ভাষা চর্চায় অনীহা নয়)- দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে বাংলা ভাষা বিশ্বে একটি দুর্লভ মর্যাদা পেলেও বর্তমানে বাংলা ভাষায় চলছে অবাধ বিকৃতি। নিজেদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া সন্তানটি প্রথিত বাংলায় কথা বলতে জানে না কিন্তু এটাই যেন মা-বাবার জন্য গর্বের হয়ে উঠে। আমাদের নবীন প্রজন্মের মুখে আজ উচ্চারিত হয় ইংরেজি, হিন্দি মেশানো এক জগাখিচুড়ি বাংলা ভাষা। বাংলা নাটক, সিনামার চেয়ে হিন্দি, কোরিয়ান তাদের কাছে পছন্দের শীর্ষে। আনিসুল হকের মা না চিনলেও ম্যাক্সিম গোর্কির মা চিনতেই হবে। আবার ভাষার মাস আসলেই ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম’ প্রবচনটি উচ্চারিত হয়। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। অপ্রয়োজনে ভিনদেশী ভাষা ও সংস্কৃতি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। শুদ্ধ বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। নতুন প্রজন্মকে ভাষার অপব্যবহার না করে জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ও সাংবিধানিক বাস্তবায়ন করতে হবে।
খন্দকার নাঈমা আক্তার নুন-শিক্ষার্থী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ-কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়- (সর্বস্তরে হোক বাংলা ভাষার প্রচলন)- বাঙালি জাতির দিন বদলের সূচনা হয়েছিল শহীদ সালাম, বরকত, জব্বারের হাত ধরেই। বাঙালিরাই ইতিহাসের প্রথম জাতি যারা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে। আজ সেই বাংলা ভাষাকে আমরা ভুলতে বসেছি। কথায় কথায় বাংলার সাথে ইংরেজির মিশ্রণ ঘটাচ্ছি। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষাতে জোর দিচ্ছে। দেশে গড়ে উঠা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষায় নাকি কথা বলতে জানে না, বাংলা বলতে নাকি তাদের কষ্ট হয়; যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। আমাদের সন্তানদের এ অভ্যাস থেকে বের করে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জন্ম দিতে হবে। চিঠি-আমন্ত্রণপত্র, তরুণ প্রজন্মের ক্ষুদে বার্তা সহ সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রতি জোর দিতে হবে। শুদ্ধ বাংলাভাষা চর্চা ও বাংলার ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতনতামূলক কাজ করতে হবে এবং বাংলা ভাষার ব্যবহার সর্বত্র নিশ্চিত করতে হবে। ভাষার মাসে শপথ হোক শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা ও বাংলা ভাষার প্রচলন।
আসিক আদনান-শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়- (বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব) – বাঙালী জাতি হিসেবে গর্ব করার মতো অনেক কিছুর মধ্যে একটি হচ্ছে আমাদের ভাষা। পৃথিবীতে এটিই একমাত্র ভাষা যে ভাষায় কথা বলার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। ভাষার জন্য পৃথিবীর আর কোথাও কেউ জীবন দেয়নি, করেনি মরনপণ সংগ্রাম। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন ১৯৪৭ এ শুরু হয়েছিলো ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এসে তা পূর্ণতা পায়। মাতৃভাষার সাথে মানুষের সখ্যতা ও পথচলার ব্যাপ্তি পুরো জীবন পর্যন্ত। শৈশবের সেই আধো বোল থেকে শুরু করে পৌঢ়তা ও বার্ধক্য পর্যন্ত এই মাতৃভাষাই আমাদের মনের ভাব অন্যকে জানানোর প্রধান সম্বল। বাংলা ভাষা আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে এক সূত্রে গাঁথতে, বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। আমি গর্বিত বাঙালী হিসেবে; একজন বাংলাভাষী হিসেবে আমার ভাষাই আমার গর্ব।
তাহমীদ হাসান শোভন-শিক্ষার্থী, ল অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ-ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া (জৌলস হারাচ্ছে বাংলা ভাষা)– দেখতে দেখতে বছর ঘুরে এল ভাষার মাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির তাজা রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি ‘মাতৃভাষা’ বলে এক মূল্যবান উপহার। কিন্তু সেই বাংলা ভাষার আজ বেহাল দশা। অবহেলায় জর্জরিত হচ্ছে দিনে দিন। বর্তমান উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের মুখে ফুটে মিশ্র ভাষা অর্থাৎ বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি সহ অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ। যা বাংলার প্রতি একটু একটু অবহেলার চরম পরিণতি। পাশাপাশি বর্তমানে ভালো চাকরির জন্য ইংরেজির বিকল্প না থাকায় তরুণরা সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি, যার কারণে পরোক্ষভাবে বাংলা হারাচ্ছে তার জৌলস। এমতাবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালত থেকে শুরু করে যেসকল কর্মসংস্থানে ইংরেজির প্রচলন বেশি সেখানে বাংলার ব্যবহার আরোও বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি।
রুকাইয়া মিজান মিমি-শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ-জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (অপপ্রয়োগের কবলে বাংলা ভাষা)-ভাষা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। পৃথিবীর প্রতিটি জাতির মতো বাঙ্গালিও নিজস্ব ভাষা লালন করছে হাজার বছর ধরে, জীবন উৎসর্গ করেও।অথচ এতো ত্যাগ তিতিক্ষাময় “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বাংলা” আজ হুমকির মুখে। প্রযুক্তির এই যুগে অপসংস্কৃতির প্রভাব আধুনিক প্রজন্মকে যেভাবে গ্রাস করছে তাতে করে বাংলা ভাষারও অপপ্রয়োগ চোখে পড়ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হরহামেশাই তারা বাংলিশ ব্যবহার করছে, হিন্দি-ইংলিশ চর্চাও বেড়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এতে করে বাংলা ভাষা ভবিষ্যৎ ভয়ঙ্কর! হয়তো একসময় এ প্রজন্ম সহজে বাংলা লিখতে পারবে না, স্বাচ্ছন্দ্যে বলতেও পারবে না। তাই এখনি এটি প্রতিহত করা খুবই জরুরি। বিশেষ করে পারিবারিক শিক্ষাতে বাচ্চাদের দেশপ্রেম ও ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জাগাতে হবে। ব্যাপক সাহিত্য চর্চায় বাংলা ভাষার ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও সামাজিক সংগঠনের যৌথ প্রচেষ্টাও খুবই জরুরী।
রাজু আহমেদ-শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ভাষাকে দূষণ ও বিকৃতি থেকে বাঁচাতে হবে)– বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। যে মাতৃভাষার আন্দোলনে নিহিত ছিলো আমাদের স্বাধীনতার বীজ। মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিলো আমাদের ভাই রফিক, জব্বার, সলাম, ররকত কিন্তুু আমরা কি সেই মর্যাদা সমুন্নত রাখার আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পেরেছি? বরং নানাভাবে ভাষাকে দূষণ করিছি, করেছি ভাষা বিকৃতি। বাংলার সাথে ইংরেজি মিশ্রণ করে কথা বলা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অন্য দিকে গণমাধ্যমে মাতৃভাষা ব্যবহারে অসতর্কতা লক্ষণীয়, ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে যাচ্ছে ভুল বার্তা। মাতৃভাষা বাংলা চর্চা সর্বত দূষণ মুক্ত হোক। ভাষার মাসে এটায় হোক আমাদের প্রত্যাশা।
রেজওয়ান আহম্মেদ-শিক্ষার্থী, ইংরেজি ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (আঞ্চলিক ভাষার সম্মান হোক)– সকল আঞ্চলিক ভাষাকে রক্ষা করিবাংলা ভাষার একটা বড় বৈশিষ্ট্যই হলো বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকম আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন। যাদের রয়েছে নিজস্ব শব্দকোষ ও রীতি। যা বাংলা ভাষাকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ দিয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করছে। শুধু কথায় নয় প্রাচীনযুগ থেকে আঞ্চলিক ভাষা কবিতা গান, সাহিত্য বা নাটকের সংলাপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ তো করেনই না, বরং হীনমন্যতায় ভোগেন। আমাদের মনে রাখা উচিত আঞ্চলিকতা মানে সংকীর্ণতা বা অনাধুনিকতা নয়, এটা আমাদের ঐতিহ্য। তাই ভাষার এই বৈচিত্রতা টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে।