
মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুর রহমান,বিভাগীয় প্রধান, ক্রয় বিভাগ, এপিক প্রপার্টিজ লিমিটেড
মানবদেহের ফুসফুসকে যেরুপ রক্তাক্ত করা যায় না তেমনি চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত সিআরবিকে রক্তাক্ত করে হাসপাতাল চাই না। সিআরবিতে বেসরকারি কোম্পানি ইউনাইটেড গ্রুপের মাধ্যমে হাসপাতাল নির্মাণ আত্মঘাতী ও জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত। নান্দনিক স্থান চট্টগ্রামের অক্সিজেন জেনারেটর সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল নয়, চট্টগ্রামের অন্যত্র স্থাপন করা হোক। আমরাও চাই চট্টগ্রামে আরো একটি হাসপাতাল হোক, তবে সিআরবিতে নয়। সিআরবি চট্টগ্রামের নান্দনিক পরিবেশে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক নিদর্শন, যা একদিনে গড়ে উঠেনি। এটি প্রকৃতি প্রদত্ত, এরকম স্থান কেউ ইচ্ছে করলে সৃষ্টি করতে পারে না। এখানে রয়েছে অসংখ্য শতবর্ষী গাছ, পরিবেশ প্রকৃতি ও ইতিহাস।
বিশেষ করে শতবর্ষী গাছগুলি বহু সংগ্রাম, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের কালের সাক্ষী হয়ে আছে। শতবর্ষী গাছের শীতল ছায়া যেন গ্রামের অনাবিল এক অপরুপ পরিবেশ। গাছপালা ও সবুজের সমারোহের দরুণ এখানে তাপমাত্রা বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে দু-এক ডিগ্রি কম থাকে বলে বলা হয়। এক একটা গাছ যেন এক একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার। পরিবেশবান্ধব এমন গাছ কেটে পরিবেশ ধ্বংস করে সিআরবিতে বাণিজ্যিক হাসপাতালের আদৌ প্রয়োজন নেই। হাসপাতাল করার সদিচ্ছা থাকলে চট্টগ্রামের আরো অনেক সুবিধামত জায়গায় করা যায়। হাসপাতাল নির্মাণের নামে চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত সিআরবির পরিবেশ ধ্বংস হতে দেয়া যাবে না। সিআরবি যেমন আছে তেমন থাকুক। সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ করতে চাচ্ছে, অনুমোদন নেওয়া হয়েছে এমন সংবাদে চট্টগ্রামবাসী বিক্ষুদ্ধ। অত:পর সিআরবি রক্ষায় সোচ্চার। চট্টগ্রামবাসী প্রয়োজনে দলমত নির্বিশেষে সবাই এককাতারে দাঁড়িয়ে ঐতিহাসিক সিআরবি রক্ষা করবে।
চট্টগ্রামবাসী আন্দোলনে নামলে পিছ পা হয়না, প্রয়োজনে জীবনোৎসর্গ করবে। একথা ভূলে গেলে চলবে না, চট্টগ্রাম হল বৃটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের মহানায়ক বিপ্লবী মাষ্টারদা সুর্যসেন ও প্রীতিলতার জন্মভূমি। সিআরবির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সিআরবি তথা পাহাড়তলী ছিল বিপ্লবীদের সূতিকাগার। ১৯৩০ সালে যুব বিদ্রোহীরা বিদ্রোহের অর্থ সংগ্রহের জন্য অভিযানচালিত ঐতিহাসিক স্থান। সিপাহী বিদ্রোহ, ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক স্মৃতি ও ঘটনার অবিস্মরণীয় স্থান। সবুজ প্রকৃতি ও শহীদের স্মৃতি বিজড়িত সিআরবি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশ পরিচালনা করছেন। ঐতিহ্য সচেতন ও প্রকৃতিপ্রেমী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রতি আলাদা টান। হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থানে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আবদুর রবের সমাধি। সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সুযোগসন্ধানী অশুভ চত্রু বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণ করতে চায়। তাই এব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আল্লাহ প্রদত্ত প্রাকৃতিক নিসর্গ সিআরবি অর্থের কাছে বিকিয়ে দেয়া যায় না। এটি বাংলাদেশ রেলওয়ের জায়গা। সরকারের সম্পত্তি। আর সরকার চলে জনগণের ট্যাক্সে। সরকারকে সেই জনগণের অনুভূতি উপলব্ধি করতে হবে। অত:পর সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে অন্যত্র সুবিধাজনক স্থানে গরীব-ধনী সকলে যাতে সহজে স্বাস্থ্যসেবা পায় এমন একটি হাসপাতাল নির্মাণই সর্বমহলের কাম্য।
তেলা মাথায় তেলের বাণিজ্যিক হাসপাতাল নয়, সাধারণ মানুষের তরে সার্বজনীন হাসপাতাল নির্মাণে ব্রতি হোন। মহামান্য রাষ্ট্রপ্রতি কর্তৃক স্বাক্ষরিত গেজেটেড ‘হেরিটেজ’ ঘোষিত সিআরবিতে আসলে শকুনের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে। তাই বিস্তারিত না জানিয়ে সুকৌশলে হাসপাতাল নির্মাণের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। কেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত সিআরবিতে ছাড়া কি অন্যত্র হাসপাতাল নির্মাণ করা যায় না ? কেন সিআরবিতে হাসপাতাল করতে চাচ্ছে তা জনগণ বুঝতে বাকি রইল না। সিআরবিতে করলে সম্ভবত: আর্থিক সুবিধায় জায়গা নিয়ে অধিক ফায়দা হাসিল করা যাবে, টাকার পাহাড় গড়তে পারবে। যদ্দরুণ সিআরবিতেই কুচত্রুীমহলের লোলুপ দৃষ্টি। এ লোলুপ দৃষ্টি প্রতিহত করতে হবে। জাগো ! চট্টগ্রামবাসী জাগো !
সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদপত্রের রির্পোট অনুযায়ী জানা যায়, ‘চট্টগ্রাম রেলওয়ের জায়গায় পিপিপিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য আহুত ইনভাইটেশন ফর বিড (আইএফবি) নোটিশে সিআরবির নাম ছিল না। ২০১৭ সালের ২০ ডিসেম্বর এই নোটিশ আহবানের পর কৌশলে সিআরবিতে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ঢোকানো হয়েছে। নোটিশে বলা ছিল চট্টগ্রামে রেলওয়ের যেকোন জায়গায়’। সিটি মেয়র রেজাউল করিমের ভাষ্যমতে, “সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সিআরবি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মারক”। এমন ঐতিহ্য ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামীলীগের সহসভাপতি আইনবিশেজ্ঞ এডভোকেট ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুলের মতে, “সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল সংবিধানের অসম্মান।
চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকাটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) দ্বারা ২০০৮ সালে ‘হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর থেকে জায়গাটি বাংলাদেশ সংবিধানের আর্টিকেল ২৪ দ্বারা সংরক্ষিত হয়ে গেছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমন্ডিত স্মৃতি নিদর্শন বস্তু বা স্থানসমূহকে বিকৃতি, বিনাশ বা অপসারণ হতে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে ‘হেরিটেজ’ ঘোষিত সিআরবিতে কোন স্থাপনা করলে সংবিধানের অসম্মান করা হবে”। পরিবেশ, প্রকৃতি ও নৈসর্গিক স্থান ধ্বংস করে হাসপাতাল নির্মাণ এ কেমন কথা ! দেশের পরিবেশবাদীরাসহ সবাই জেগে উঠুন। আসুন, সবাই পরিবেশ, প্রকৃতি ও নৈসর্গিক স্থান সিআরবি রক্ষার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিহত করে দিই। ধন্যবাদ ও শোকরিয়ার বিষয়, ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে পাঠানো চট্টগ্রামের ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের প্রতিবাদমূলক বিবৃতি সত্যিই প্রসংশনীয় ও প্রণিধানযোগ্য। তাছাড়া চট্টগ্রামদরদী ও প্রকৃতিপ্রেমী বিভিন্ন পেশাজীবী, সাংবাদিক, আইনজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীসহ অনেকেই সপ্রণোদিত অভিমত ও জোরালো প্রতিবাদমূলক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে অতীব পরিতাপের বিষয়, স্বনামধন্য সুপরিচতি অনেকেই এখনও নিশ্চুপ আছেন। সম্ভবত: যারা নিশ্চুপ তারাও কোন না কোনভাবে কুচত্রুীমহলের সাথে জড়িত।
নতুবা সোচ্চার হয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ভূতপূর্ব সিটি মেয়র চট্টলদরদী মরহুম এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কথা কি আপনারা ভূলে গেছেন ? মিনতি করি, আসুন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সিআরবি রক্ষায় স্বীয় স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে এক হয়ে দুর্নিবার গণআন্দোলন গড়ে তুলি, যাতে কুচত্রুীমহলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হয়। জাগো জনতা, বাঁচাও সিআরবি। আসুন এবার জেনে নিই, সিআরবি কী ? কী তার পরিচয় ? সিআরবি এটি মূলত: সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং, যা সিআরবি নামে পরিচিত। “সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের কোতোয়ালী থানার অধীনে টাইগার পাস সংলগ্ন পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত। এটি বাংলাদেশ রেলওয়ের (পূর্বাঞ্চলীয়) মহাব্যবস্থাপকের নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়। ১৮৭২ সালে সম্পূর্ণ হওয়া ভবনটি, বন্দরনগীর প্রাচীনতম ভবন। এর পূর্বদিকে, সিআরবি সড়কজুড়ে রয়েছে রেলওয়ে হাসপাতাল যা ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে একটি ৫০ শয্যাবিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ স্থাপনে প্রস্তাবনা ছিল এবং বর্তমানে যা ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে। সিআরবি পার্শ্ববতী স্থানে রেল কর্মকর্তাদের জন্য একটি আবাসিক এলাকাও গড়ে উঠেছে। সিআরবি পাহাড়ে রয়েছে হাতির বাংলো। এছাড়াও কেন্দ্রের দিকে রয়েছে শিরিষতলা নামে একটি প্রশস্ত মাঠ, যেখানে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফালগুন ইত্যাদি ঐতিহ্যগত উৎসব আয়োজিত হয়ে থাকে। চট্টগ্রামে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের দু’শো বছরের ইতিহাস বলে, কিছু বাকি ভবনগুলোর মধ্যে একটি সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং। ১৭৬০ সালে ব্রিটিশ শাসকরা নবাব মীর কাসিমের কাছ থেকে চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং ভারত বিভাগের আগে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটি শাসন করেছিল। তাদের শাসনকালে ব্রিটিশরা তাদের প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বেশ কয়েকটি ভবন নির্মাণ করেছিল এবং এই বিল্ডিংগুলির মধ্যে একটি হল সিআরবি।” তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ। সিআরবিতে স্থাপিত বর্তমানে দৈন্যদশা যে হাসপাতালটি প্রাণহীন হয়ে আছে তা প্রাণবন্ত করে চিকিৎসাসেবা পেতে অনুগ্রহপূর্বক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। সিআরবিকে পারলে রমনার রুপ দিন। চট্টগ্রাম তথা দেশবাসীর নিকট অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আর জানা যায়, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে দৃষ্টিনন্দন ও সুবিশাল রেলওয়ের অনেক জায়গা রয়েছে। সেইগুলির একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে সন্দীপ চ্যানেল। যেখানে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ, বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির মত ঐতিহ্যবাহী ও সুবিশাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসবের আশেপাশেই প্রাকৃতিক পরিবেশে সুবিধাজনক জায়গায় হাসপাতালটি নির্মিত হলে হাসপাতালের প্রয়োজন যেমনি মিটবে তেমনি সিআরবিও অক্ষত থাকবে। সিআরবিকে অক্ষত রেখে চট্টগ্রামের রেলওয়ের অন্য জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণ করা হোক, এটাই গণমানুষের দাবী।