
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদেরই বাংলাদেশ। বহুকাল ধরে চলে আসছে ঋতু বৈচিত্র্যে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। এই ছয় ঋতুর দেশে পৌষ ও মাঘ মাস শীতকাল হলেও প্রকৃতিতে শীত হাজির হয় আরো আগে। প্রকৃতিতে এখন শীতের আমেজ বিরাজমান। আমরা জানি যে, ভোরের মিষ্টি আলো ধানক্ষেতের ওপর ছড়ানো শিশির কণা, হাট-বাজারে দেখতে পাওয়া যায় টাটকা শাকসবজি, অতিথি পাখির গুঞ্জন, ঘাসের উপর কুয়াশার রূপালি ফোঁটা, বিকেলে মৃদু শীতল হাওয়া জানান দেয় ঋতুর পালাবদলে শীতের আগমনীবার্তা। আর এই শীতের আভাস চোখে পড়ছে বাংলার পথে প্রান্তরে। তবে প্রতি বছরই শীত আসে। আবার চলেও যায়। কিন্তু শীতের আমেজে তবু মন শুধু চায় শৈশবে হারিয়ে যেতে। সত্যি সেইদিনগুলো কতই না সুমধুর ছিলো। শীতকাল আসলেই খুব মনে পড়ে যায় হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলোর কথা। প্রসঙ্গ যখন শীতকাল তখন সরিষা ক্ষেতের আল ধরে বহুদূর পথচলা, ফজরের নামাজ পড়ে বাহিরে দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়া আরও অনেক কিছু। শীতের আগমনী বার্তা মানেই পিঠা-পুলি, খেজুর রস, রঙবেরঙের শাক-সবজী, শতশত ফুলের সমারোহ আর সরষে ক্ষেতের হলুদ গালিচার চোখ ধাঁধানো মনোরম দৃশ্যের কথা না বললেই নয়। দেশে উত্তরাঞ্চলে শীত বেশি অনুভূত হয়। এ অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জীবনে বর্ষার মতো শীতকালও বয়ে আনে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। আমরা জানি, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পেশাগত দিক থেকে কৃষির সাথে জড়িত। তাই শীতের সকালেও তাদের শীতের আরাম ও আনন্দকে উপভােগ করার সময় থাকে না শীতের কুয়াশা ভেদ করে লাঙল নিয়ে তারা হােটে ফসলের মাঠে। শীতকালে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে দুর্ভোগ দেখা দিলেও গ্রামীণ জনপদে শীতকাল হাজির হয় নানা বৈচিত্র্যের সম্ভারে। শীতে গ্রামের প্রকৃতি হয়ে উঠে প্রাণবন্ত।
তবে শীতকালের স্মৃতি বলতে শৈশবে পাড় করা বছরের শেষ আর শুরুর দিন গুলোর কথা খুব বেশিই মনে পড়ে। কেননা সে সময়ে শীত আসতো একখন্ড আনন্দ নিয়ে। আর এই আনন্দের শুরু হতো স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হবার মাধ্যমে। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে বসতে হতো ফাইনাল পরীক্ষায়, শীতও তখন আসি আসি ভাব। তখন সময় এবং মাসের সঠিক হিসাবটা না জানলেও শীতকাল আসলেই পরীক্ষার আমেজ এবং পড়ালেখা থেকে মুক্তির বার্তা আসতো। এমনকি তখন গ্রামের সমবয়সীরা মিলে পিকনিকের আয়োজন করা হতো।বিভিন্ন রকমের খেলার আয়োজন করা হতো। এমন দিনগুলো আর আসেনা, সময় এবং বড় হওয়ার সাথে সাথে সবকিছু বিলীন হয়ে যাচ্ছে । শুধু রয়ে গেছে শৈশবের স্মৃতিগুলো। শীতের তুষারে ঢেকে যাওয়া গ্রামের বাড়িতে পৌষ মাসে সারা রাত ঢেঁকিতে চাল কুটে সাদা আটা ভানা হতো। ভোরবেলা ভাপা পিঠা আর পুলি পিঠায় সকাল শুরু হতো। সাথে খেজুরের রসের পিঠা, পায়েস থাকতো। এমনকি গ্রামে সবাই গোল হয়ে বসে আগুন পোহানোর ব্যাপারটা ছিল অসাধারণ। সত্যি সেইদিনগুলো সকলেই মিস করি এখন।
দেখা যায় বর্তমান প্রজন্মে শীত আসে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোচিং করা অথবা ক্লাস নিয়ে, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না হবার একরাশ হতাশা নিয়ে, ট্যুরে যাওয়া বা না যাওয়ার হিসেব কষতে কষতে। আর আমাদের শীত আসতো এলাকার সমবয়সীদের নিয়ে নিজেরাই রান্না করার একটি পিকনিক নিয়ে, নতুন বইয়ের গন্ধ নিয়ে, বিজয় দিবসের পিটি প্যারেড আর মাতৃভাষা দিবসে সবার আগে ফুল দেবার প্রতিযোগিতা নিয়ে। মূলত শীত মানেই যেন উৎসবেরও আমেজ । চারদিকে বিয়ের ধুম পড়ে যায়, ফ্যামিলি ট্যুর, প্রাতিষ্ঠানিক ট্যুর, ঘোরাঘুরি সবমিলিয়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি করে । অন্যসব ঋতুর চেয়ে শীতই আমার কাছে প্রিয় ঋতু মনে হয়। আজ দূরে থেকে এসবের আমেজ আর পাইনা। আজ সবাই আছে; তবুও মনে হয় কোথাও কেউ নেই। অথচ তাদের সাথে কাটানো শৈশবের স্মৃতি বার বার উঁকি দিচ্ছে মনে। এখন শীত ঠিকই আসে কিন্তু সেই আমেজ আর ফিরে আসেনা। সত্যি সেইদিনগুলো কতই না মধুর ছিলো জীবনে। লেখকঃ শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ