
অমর একুশে বইমেলা ২০২২ ইতিহাসনির্ভর উপন্যাসের বইয়ে আগ্রহ বেড়েছে পাঠিকদের। এবারের বইমেলায় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা ঘটনাপ্রবাহের ইতিহাস নিয়ে বের হয়েছে বই। পাঠকরাও সেসব বই কিনছেন আগ্রহভরে।
গতকাল সোমবার বইমেলা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি স্টলেই ইতিহাসের এমন নানা দিক নিয়ে এসেছে অসংখ্য বিষয়ভিত্তিক বই। এসব বইয়ের প্রতি পাঠকের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। কাটতিও বেশ ভালো। এসব বইয়ের পাঠক একটু বয়সী হলেও তরুণ পাঠকরাও ইতিহাসের বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠছেন। প্রকাশক ও বিশিষ্টজন এমন কথাই জানালেন। বইমেলায় গতকাল পর্যন্ত বের হয়েছে ২ হাজার ৯৪৭ টি বই। এর মধ্যে ইতিহাস বিষয়ক বই মাত্র ৫৯ টি বই। বই বের হলেও বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসনির্ভর বইয়ের সংখ্যা পঞ্চাশও ছাড়ায়নি। এক্ষেত্রে পাঠকদের আগ্রহের ঘাটতির পাশাপাশি উপযুক্ত লেখকের সঙ্কটের কথা বলছেন সাহিত্যিকরা। তবে সংখ্যায় কম হলেও মানসম্পন্ন ইতিহাসনির্ভর বই বের করার দিকে বেশি জোর দিলেন তারা।
এ বিষয়ে লেখক ইতিহাসবিদ মেসবাহ কামাল বলেন, ইতিহাসের বইয়ের প্রতি মানুষের ব্যাপক আগ্রহ আছে। মানুষ নানা বিষয় সম্পর্কে ইতিহাস থেকেই জ্ঞান আহরণ করে। জাতি, ভাষা, বর্ণ, সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়ে ইতিহাসের শিক্ষা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তাই এসব বই গুরুত্বসহকারে যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করতে হবে। বইমেলায় ঘুরতে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্মিতা জান্নাত বাণিজ্য প্রতিদিনকে জানান, ইতিহাস হলো অতীতের ঘটনার বিবরণ। অতীতের ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য-প্রমাণের সাহায্যে অনুসন্ধান করা। বাংলাদেশের বাঙালীদের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। সেই ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে প্রধান অনুঘটক হিসেবে পৌঁছে দেয় বই। জাতি এ থেকেই আগামী দিনের পথচলার দিকনির্দেশনা পায়।
বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, মেলায় এ পর্যন্ত ইতিহাসের নতুন বই এসেছে অর্ধশতাধিক। এবারের বইমেলায় বাংলা একাডেমি এনেছে জালাল ফিরোজের ‘অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস’, সময় প্রকাশন এনেছে মুনতাসির মামুনের ‘বঙ্গবন্ধু সমগ্র : প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড’, ‘আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ : প্রথম খণ্ড ও দ্বিতীয় খণ্ড ও ‘মহাত্মা গান্ধী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’, দিলীপ চক্রবর্তীর ‘তাহাদের স্মরণীয় বিচার’, মোত্তালিব বিশ্বাসের ‘সঙ্গীত ভাবনা’, এবিএম রেজাউল করিমের ‘উন্নয়ন ও অবনমন পরিক্রমা’, শামীমা সুলতানার ‘ইংল্যান্ডের ইতিহাস’, আগামী প্রকাশনী এনেছে সালাহউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস’, আনিসুজ্জামানের ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর ‘, মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর ‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ’, ওবায়দুল কাদেরের ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, এ আর মল্লিকের ‘আমার জীবনকথা’, এইচটি ইমামের ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’, আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ‘স্মৃতি অম্লান ১৯৭১’, আবুল কাশেম ফজলুল হকের ‘মুক্তিসংগ্রাম’ উল্লেখযোগ্য।
অমর একুশে বইমেলার ২৮তম দিনে মেলা চলে বিকেল ৩:০০টা থেকে রাত ৯:০০টা পর্যন্ত। এদিন নতুন বই এসেছে ৭৬টি। এছাড়াও আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বিকাল ৪:০০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আলোকবর্তিকা এবং ড. মুহম্মদ এনামুল হক : জীবন ও সৃজন শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হাকিম আরিফ এবং সৌরভ সিকদার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আনোয়ারুল হক, ললিতা রানী বর্মন এবং মাসুদ রহমান। সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ আজিজুল হক।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আলোকবর্তিকা শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থান করে হাকিম আরিফ বলেন, বাংলাভাষী অঞ্চলে ভাষাচর্চা বা তাত্ত্বিকভাবে ভাষাবিজ্ঞানের প্রসঙ্গটি যখনই উত্থাপিত হয়, তখন অপরিহার্যভাবেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নাম চলে আসে। বাংলা ভাষার চর্চা বা ভাষার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের বিষয়টি ছিল তাঁর আবেগের অংশ, জীবনযাপনের মতোই নৈমিত্তিক।
ড. মুহম্মদ এনামুল হক : জীবন ও সৃজন শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে সৌরভ সিকদার বলেন, বাংলার মনীষী ড. মুহম্মদ এনামুল হক গবেষণাক্ষেত্রে যেমন মেধাবী ছিলেন, তেমনি প্রশাসনিক দক্ষতা ও কর্মতৎপরতায় ছিলেন অনন্য। বাংলাভাষা ও সাহিত্যের গবেষণায়, বাংলাভাষার পরিকল্পনায় ও এ অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। আলোচকবৃন্দ বলেন, বাংলা ভাষা চর্চা, গবেষণা ও উন্নয়নে দুই অবিস্মরণীয় কীর্তিমান বাঙালি ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং ড. মুহম্মদ এনামুল হক। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে তাঁরা বুকে ধারণ করেছিলেন। শিক্ষা, সাহিত্য ও ভাষার মেরুদন্ড কেমন হবে সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এ দুজন জ্ঞানতাপস। সর্বোপরি বাংলা ও বাঙালির ভিত রচনার ক্ষেত্রে এই দুই মহান প্রতিভা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছেন।
সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং ড. মুহম্মদ এনামুল হক জ্ঞানসাধনা ও চর্চায় একনিষ্ঠ ছিলেন সারাটি জীবন। বাংলা ভাষা গবেষণা ও উন্নয়নে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। জাতিকে যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি বিনির্মাণে তাদের ভূমিকা প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজের বই নিয়ে আলোচনা করেন অনিকেত শামীম এবং রেজাউদ্দিন স্টালিন।
আজকের অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি রুহুল মাহবুব, সাঈদ তপু, সাবেদ আল সাদ এবং লুৎফর চৌধুরী। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী তারেক আলী, মাহফুজা আক্তার মিরা, আফরোজা কণা এবং শাহীন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘প্রাকৃতজন’, অমিত হিমেলের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সমস্বর’ এবং আবদুল্লাহ বিপ্লবের পরিচালনায় ‘ঘাসফুল’-এর পরিবেশনা। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন জয় প্রসাদ সিংহ রায় (তবলা), মো. মামুনুর রশিদ (বাঁশি)।
আজ মঙ্গলবার অমর একুশে বইমেলার ২৯তম দিনে মেলা চলবে বিকেল ৩:০০টা থেকে রাত ৯:০০টা পর্যন্ত। প্রতিদিনের ন্যায় রয়েছে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকাল ৪:০০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ভাষাসংগ্রামী অজিত কুমার গুহ : জীবন ও কর্ম শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন হাসান ইমাম মজুমদার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন এবং রাজীব সরকার। সভাপতিত্ব করবেন বেগম আকতার কামাল। এছাড়াও সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।