
মহল্লার তিন রাস্তার মাথা—তেমহনি।
মামুন ভাই গা এলিয়ে বসে আছেন। চেহারায় ক্লান্তি। পায়ে রক্তের আনাগোনা কম, সাদাটে হয়ে গেছে। হাতগুলোরও একই অবস্থা।
সূর্য ডুবে গেছে; তবে রাত আসেনি। নির্লিপ্ত আকাশে ধোঁয়াটে মেঘ। মেঘের আড়ালে শুভ্র চাঁদ। মামুন ভাইয়ের চোখটা সেখানে।
কি হে মামুন ভাই, এত ক্লান্তি? হাত-পায়ের এ অবস্থা কেন? আকাশ থেকে চোখ সরে তার৷ আমায় দেখে মৃদু হাসে। হক সাব, কী অবস্থা?
—আমার অবস্থা তো আলহামদুলিল্লাহ; কিন্তু আপনারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না৷ ঘটনা কী, বলুন তো। প্রশ্ন শোনে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সে। একটা ছবি দেখাতে দেখাতে বলে, ‘তেমন কিছু না, এটা দেখ’৷
চিত্রটা এমন: বিলের মাঝে ছোট্ট আল। দুদিকে ধানক্ষেত৷ এসব মাড়ি দিয়ে একটা খাটিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। ছয় থেকে সাতজন সেটা বহন করছে৷ সবার শরিরে সাদা পোশাক। পায়ে সৈনিকদের লম্বা জুতা। চোখে মোটা চশমা। কবজি পর্যন্ত হাতমোজো। এটাকে ‘পিপিই’ বলে। পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট। সুরক্ষা পোশাক। ডাক্তাদের পড়তে দেখা যায়।
মামুন ভাইয়ের প্রশ্ন—কী বুঝলি?
—ডাক্তাররা একটা লাশ নিয়ে কোথাও যাচ্ছে।
—এরা ডাক্তার নয়; তৈয়ব শাহ (রহ.)’র প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া কমিটির সদস্য। এদের মাঝে কোনো একজন আমি। ছবিটি লাশ ধোয়ার পরের। লাশ ধুয়েছিলাম আরো ২০০ মিটার আগের জায়গায়। এর পরে আরো এক থেকে দেড়শো মিটার পাড়ি দিয়েছি। মোট ৩০০ থেকে ৩৫০ মিটারের মতো এভাবে হাঁটতে হয়েছে। এরপর জানাজা, লাশ দাফন। সবটা আমরা-আমরাই। প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টার দীর্ঘ কর্মযজ্ঞ—বলতে বলতে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি।
তাঁকে থামালাম। বললাম, লোকটা কে? আপনার কোনো আত্মীয়-স্বজন?
—আরে নাহ, আমার কেউ না। এমন কি, আমাদের মধ্যেও কারোর কেউ না।
—ওওও, তাহলে নিশ্চয় বেওয়ারিশ। বেচারার স্বজন বলতে কেউ নেই সম্ভবত!
—আরে নাহ, বাপ আছে, ভাই আছে, বউ-পোলা সব আছে।
এবার মাথাটা খাড়ার উপর কয়েক চক্কর ঘূর্ণি খেলো। মেলাতে পারছি না কিছু। সবাই থাকলেও আপনারাই সবকিছু… মানে কী?
—মানে টানে নাই। লোকটার শরিরে করোনার উপসর্গ ছিল। মরেছে হাসপাতালে। ওখান থেকে তার ভাইয়ের অনুরোধে আমরাই নিয়ে গেছি। এরপর কাফন-দাফন-জানাজা সবটা আমরা আমরাই।
বিনিময়ে আপনারা কী পেলেন?
—আল্লাহর করুণা, নবীজির সন্তুষ্টি, মুর্শিদের সুনজর। এসব পাচ্ছি হয়ত! এর বাইরে আর কোনো লাভ নেই। কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আসা-যাওয়ার পথখরচাও আমাদের পকেটের।
কণ্ঠে জমাট বেঁধে যাচ্ছিল। আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিলাম না। হাত-পা শিরশির করছিলো। নিজেকে মৃত লাশ হিসেবে কল্পনা করতে লাগলাম। চোখ বন্ধ করে দেখতে পেলাম, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, মহল্লাবাসী সবাই ঠেলে দিয়েছে। সবাই ত্যাগ করেছে। সবাই থেকেও কোথাও যেন কেউ নেই। ঠিক এমন সময় অপরিচিত কতগুলো সাদা পোশাকাধারী লোক এসে অবহেলিত আমায় পরম যত্নে গোসল, জানাজা, কাফন-দাফন দিচ্ছে…
চোখের জল গড়িয়ে গাল অতিক্রম করেছে। অবস্থা দেখে মামুন ভাই, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে আরো কিছু শব্দ। সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই। কোনো সংজ্ঞা নেই। পৃথিবীর অদ্বিতীয় শব্দগুচ্ছে তিনি বলেন, “এ ধরনের ওয়ারিশ ওয়ালা বেওয়ারিশ লাশ প্রায় চারশোর কাছাকাছি দাফন করেছে গাউসিয়া কমিটি। সারা দেশেই চলছে এর যাত্রা। মুসলিম না শুধু; হিন্দু বৌদ্ধও এ করুণা থেকে বাদ যায়নি। নজরুলের ভাষায় ‘যেখানে এসে মিশে গেছে সব বাধা ব্যবধান’।”
কণ্ঠের জোর থেমে গেছে বহু আগেই। ভাবনাটা চালু আছে শুধু। পাকিস্তানি পীরগুলোর কথা ভাবছিলাম। সুদূর বাংলায় এসে তাঁরা কী দিয়ে গেল! নিলোই বা কী? সিরকোটের পাহাড়ি অঞ্চলের আলো বাংলার বেওয়ারিশ লাশের ওপর। সে আলোর উৎস কোথায়? সিরকোট? মামুন ভাইয়ের হাতে শাজরা নামক বই ছিলো। টেনে নিয়ে উল্টালাম। একটি সিলসিলা— সাবের শাহ, তাহের শাহ, তার উপর তৈয়ব শাহ, তার উপর আহমদ শাহ… উঠতে উঠতে শৃঙ্গে পৌঁছলাম। সেখানে অবস্থান করছে একটি নাম—মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সবছে আওলা ওয়া আ’লা হামারা নবী।
আলোর উৎস পেয়ে গেলাম। যার আলোয় দুনিয়া আলোময়। বুঝে পেলাম, এ কমিটি রাহমাতুল্লিল আলামিনের একটি রহমত। করোনাকালে করুণাময় খোদার করুণার এক রূপ। যেখানে সবাই তটস্থ, মৃত্যুভয়ে ভীত, ঠিক সেখানেই এরা আলোর ঝলকানি নিয়ে হাজির। মেঘের আড়ালে যেন একখণ্ড শুভ্র চাঁদ।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি।
এই করোনাকালে করোনা-টরোনার ছুঁতো পেয়ে যদি মরে যাই,
যদি লাশটা পড়ে থাকে অবহেলায়;
তবে তাহের শাহের রুহানি বাচ্চাদের খবর দিয়ো।
খবর দিয়ো ভাই,
গাউসিয়া কমিটির বীরপুরুষদের।
লোকেদের বলতে শোনেছি—“শেষ বিদায়ের সাথি, গাউসিয়া কমিটি।”
লিখাঃ মুহাম্মদ সৈয়দুল হক, চট্টগ্রাম।